হঠাৎ করেই মোবাইলটা বেজে উঠলো। আয়েশা দেখে তার স্বামী সজল সৌদি থেকে ফোন দিয়েছে। কয়েকদিন থেকেই শুনছে সৌদিতে করোনা ভাইরাসে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।তাড়াতাড়ি মোবাইলটা রিসিভ করলো আয়শা। সজলকে দেখে আয়শার বুক কেযন করে উঠলো। সারাক্ষণ কাশি দিচ্ছে, সাথে নাকি জ্বরও আছে। কিছু খেতে পারছে না। হাসপাতালেও রোগী ভর্তি।ডাক্তার দেখাতে পারছে না। ডাক্তারের কাছ থেকে শুনে ঔষধ এনে খাচ্ছে। ছেলেদের দেখতে চাইলো। ছেলেদের দেখেই সজল ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলতে লাগল। ভালো করে কথাই বলতে পারলো না। সবাইকে দোয়া করার কথা বলে মোবাইলটা রেখে দিল।
আজ থেকে পনের বছর আগে সজলের সাথে আয়শার বিয়ে হয়। তখন তার বয়স আর কত ষোল শেষ হয়ে সতের।মাত্র এসএসসি পাশ করেছে। গরীব কৃষক বাবার ছয় মেয়ের মধ্যে সে সবার বড়। তার ফুফু এই বিয়ে এনেছে।সজলের মা ফুফুর ননদ। হঠাৎ করে সজলের বাবা মারা গেলে সজলকে তার মামার কাছে রেখে সজলের মাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেন। সজলের মামা আগে থেকেই সৌদি থাকেন। সজল তার মামাতো ভাই বোনের সাথে বড় হতে থাকে। তার মাকে নতুন বাবা আসতে দেয় না। কতদিন সজল মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে বুঝতে পারে তার মা আর কখনও আসবে না। সজল এইচএসসি পাস করার পরই তার মামা তাকে সৌদি নিয়ে এক কোম্পানিতে কাজ দিয়ে দেন।
দশ বছর এক নাগাড়ে সৌদি থাকার পর সজল দেশে এসেছে তিন মাসের ছুটি নিয়ে বিয়ে করার জন্য। অনেক মেয়ে দেখানো হয় সজলের কাউকেই পছন্দ হয় না । তখন ফুফু সজলকে নিয়ে আয়শাদের বাড়িতে আসলে আয়শাকে দেখেই সজলের পছন্দ হয়ে যায়। তিন দিন পরই সজলকে বিয়ে করিয়ে ফুফা ফুফু পাকাপাকি করে আয়শাকে ফুফুর বাড়ি নিয়ে যান। আয়শার যখন সজলের সাথে বিয়ে হয় তখন সজলের বয়স ত্রিশ। এত বয়সের পার্থক্য তবুও তাদের মধ্যে গভীর ভালবাসা গড়ে উঠে।
দেখতে দেখতে সজল আর ওর ফুফার যাওয়ার সময় হয়ে যায়। চোখের পানিতে আয়শা সজলকে বিদায় দেয়। তারপর থেকে শুরু হয় দুইজনের বিরহের দিন রাত। চিঠি গুলো হলো তাদের সাক্ষী।
বছর না ঘুরতেই আয়শার ফুটফুটে এক ছেলে হয়। ছেলের ছবি দেখে আর সজল কষ্টে নীল হয়ে যায়।ছেলের নাম রাখে আনাস।তারপরও টাকার কথা চিন্তা করে দেশে আসে না। সজলের দুই মামাতো বোনের একই দিনে বিয়ে ঠিক হলে সজলের মামা একাই এসে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে যান। তখন সজল আয়শার আর ছেলের জন্য অনেক কিছু পাঠায়।
ছয় বছর পর সজল দেশে আসে।ছেলেকে দেখে সজল আনন্দে আত্মহারা। আয়শার জন্য একটা মোবাইল আনে। এবার সজল মফস্বল শহরে বাড়ি করার জন্য এক টুকরো জায়গা কিনে। দুই শালীর বিয়ে দেয়।সজলকে তার শ্বশুর শাশুড়ি নিজের ছেলের মত ভালোবাসে।
সজল আবার ফিরে যায় তার কর্মস্থলে। আবারও সজলের ছেলে হয়।সজলের খুব শখ ছিল মেয়ের। দুই জনে ফোনে ভবিষ্যতের কত স্বপ্ন বুনে। ছেলেদের পড়াশুনা করায় বড় অফিসার বানাবে।
এবার সজল পাঁচ বছর পর আসে। দুই ছেলেকে জড়ায় ধরে অনেক কান্নাকাটি করে। ততদিনে বড় ছেলে সিক্সে। সজল বাড়ির কাজ ধরে। থাকার মতো করে ওদেরকে বাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বড় ছেলেকে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আবার চলে যায়।
এখন ভিডিও কলে সময় পেলেই কথা হয়। এমনও হয়েছে সারারাত জেগে কথা বলে সকালে একটু ঘুমায় কাজে যায়। আয়শাকে বার বার বলে এবার মেয়ে চাই।এবার আল্লাহ তাদের মেয়েই দেন। সজল ভিডিও কলে মেয়েকে দেখে। কিন্তু আয়শা বুঝে ভিডিও কলে মেয়েকে দেখে সজলের মন ভরে না ।তার মন চায় মেয়েকে কোলে নিয়ে থাকতে। আয়শাকে সে বার বার বলে এবার দেশে আসলে আর যাবো না। দেশেই কিছু করবো। ছেলে দুটো বড় হয়ে যাচ্ছে, মেয়েকে না দেখে শুনে রাখবো।
চার বছর পর ছুটি নিয়ে ছিল দেশে আসার জন্য সজল। রোজার ঈদ এসে সবার সাথে করবে। দেশে কিছু করতে পারলে আর বিদেশ যাবে না বলেছিল। এর মধ্যেই করোনা ভাইরাসের কারনে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। দেখতে দেখতে রোজা প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, ঈদের আর চার পাঁচ দিন বাকী। এই মূহুর্তে সজলের অসুস্থতা আয়শাকে অস্থির করে তোলে। সবাই সজলের জন্য দোয়া করতে থাকে। আয়শা বার বার ফুফার কাছে ফোন দেয়। ফুফাও বলেন আল্লাহর কাছে দোয়া কর।
আয়শা দিন রাত নামাজের বিছানাতেই বসে থাকে। সাথে ছেলে দুটোও। ঈদের রাতে সজল ফোন দিয়ে আয়শাকে বলে বৌ বিয়ের শাড়িটা পরে বিয়ের দিনের মত করে একটু সাজতো। তোমাকে বিয়ের দিনের মত দেখতে ইচ্ছে করছে। আয়শা কাঁদতে কাঁদতে সেজে সজলের সাথে কথা বলে।সজল আয়শাকে দেখে বলে বৌ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। কিন্তু সজল বেশী সময় কথা বলতে পারেনি। আজকে সজলকে অনেক বেশী অসুস্থ লাগছে। সজল মোবাইল রেখে দেয়। আয়শা সারারাত আল্লাহর কাছে সজলের প্রাণ ভিক্ষা চায়। অসুস্থ হোক যাই হোক তার সজলকে যেন আল্লাহ্ তার কাছে ফিরিয়ে দেন। কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন নামাজের বিছানাতেই আয়শা ঘুমায় যায়।
ফজরের আজানের শব্দে আয়শার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ছেলেদের ডেকে তুলে তাড়াতাড়ি করে ওজু করে আয়শা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সজলের জন্য ছেলেদের নিয়ে দোয়া করতে থাকে।
নামাজের বিছানায় থাকতে থাকতেই মোবাইলটা বেজে উঠে। আয়শা কাঁপা হাতে মোবাইলটা নিয়ে দেখে ফুফা ফোন করেছে। রিসিভ করতেই শুনে ফুফা কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন আয়শা সজল আর নেই।
লেখক-
আফরোজা মুন্নি